আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অঙ্গ-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখিরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না, খুন-রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি ॥
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনিগন্ধা অলকানন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো॥
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবিকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি ॥
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহিদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালব ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি ॥
রক্তে রাঙানো — বহু মানুষের আত্মোৎসর্গে সিক্ত বা উজ্জ্বল।
অশ্রু-গড়া — চোখের পানিতে নির্মিত।
বসুন্ধরা — পৃথিবী।
ক্রান্তি — পরিবর্তন।
লগন — লগ্ন, উপযুক্ত বা শুভ সময়।
অলকানন্দা — একটি ফুলের নাম।
ওরা গুলি ছোড়ে — এখানে পাকিস্তানি পুলিশকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর তারা গুলি ছুড়েছিল।
এই কবিতা পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভাষা-আন্দোলনে বাঙালির আত্মত্যাগ নিয়ে একদিকে গর্ব করতে শিখবে, অন্যদিকে তারা শহিদের রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য সব ধরনের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলনে ‘একুশের গান' প্রথম ছাপা হয়। এখানে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ভাষা-আন্দোলনে বাঙালি ছাত্র-জনতার আত্মোৎসর্গকে স্মরণ করা হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের রক্তদান কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায় না। এখানে অন্যায়ভাবে গুলিবর্ষণকারী তৎকালীন পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির জাগ্রত প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কথাশিল্পী, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট হিসেবে খ্যাতিমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সমাজমনস্ক লেখক হিসেবে ভাষা-আন্দোলন (১৯৫২) ও মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) চলাকালে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ হলো 'ডানপিটে শওকত’, ‘আঁধার কুঠির ছেলেটি' ইত্যাদি । তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে মে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
ক. একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন উপলক্ষে একটি দাওয়াতপত্র তৈরি করো (একক কাজ)।
খ. একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করে তোমাদের লেখা কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে একটি দেওয়াল পত্রিকা তৈরি কবো (দলগত কাজ)।